বিডিনিউজ ১০ রিপোর্ট: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দিন সকালে খুনিদের ছোড়া কামানের গোলায় মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডে ১৩ জন নিহত হয়েছিলেন।
এ ঘটনায় করা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ (অভিযোগ) গঠনের এক যুগ পার হলেও বিচার শেষ হয়নি। আদালতে ১৮ জন সাক্ষ্য দিলেও অন্যরা সাক্ষ্য না দেয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে খুনিদের ছোড়া কামানের গোলায় হতাহত দরিদ্র পরিবারগুলো এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার সহায়তা পায়নি। ওই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারের পাশাপাশি তারা তাদের নিজেদের পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন।
ঘটনার সময় ২৪ বছরের যুবক ছিলেন মামলার বাদী মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী। যুগান্তরকে তিনি বলেন, মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডের আমাদের ৮ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিন সকাল সাড়ে ৫টায় কামানের গোলা এসে পড়ে।
ওই সময় বাড়ির ভাড়াটিয়া ও গ্রামের লোকজন অবস্থান করছিলেন। কামানের গোলায় আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয় রিজিয়া বেগমসহ ১৩ জন নিহত এবং ৪০ জন আহত হন। আহতদের তাৎক্ষণিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়।
এ ঘটনায় মামলা করতে গেলে তৎকালীন মোহাম্মদপুর থানার ওসি রব দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির অজুহাতে মামলা না নিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দেন। আর কামানের গোলায় নিহত লাশগুলো কবর দিতে বলেন।
একপর্যায়ে ১৫ আগস্ট যা কিছু হয়েছে এ ব্যাপারে কোনো মামলা করা যাবে না- এ সংক্রান্ত আইন সংসদে পাস হয়। মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, ফলে অনেক চেষ্টা করেও ওই সময় আর মামলা করা সম্ভব হয়নি। পরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এলে ওই কালো আইন বাতিল করা হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে মোহাম্মদপুর থানায় মামলাটি করি।
তিনি বলেন, ওই ঘটনার সময় উপস্থিত অনেকেই রয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষ চাইলে তারা আদালতে সাক্ষ্য দেবেন। পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। তিনি আরও বলেন, ওই ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত পরিবারগুলোকে কোনো প্রকার আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়নি। ওই পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সাইফুল ইসলাম হেলাল যুগান্তরকে বলেন, এ মামলার বিচার কার্যক্রম দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। বিএনপি সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মামলার বিচারিক কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। ২০০৯ সালের পর মামলা গতি পায়। এরপর বিচার কার্যক্রম শেষ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে।
সাক্ষী হাজিরের ক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছেন আদালত। সাক্ষীদের বিরুদ্ধে সমনের পর অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়নাও জারি করা হয়েছে। সাক্ষীদের হাজিরের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব স্থানে দফায় দফায় চিঠি দেয়া হয়েছে।
বারবার সমন পাঠানোর পরও মামলার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন সাক্ষী আদালতে আসেননি। তবে অনেক সাক্ষী ঠিকানা পরিবর্তন করায় তাদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ইতিমধ্যে তিন পুলিশ কর্মকর্তা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ হবে বলে আশা করছি।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালের ১৯ মার্চ বাদীর প্রথম সাক্ষ্য নেয়া হয়। এরপর দীর্ঘদিন বাদীর পূর্ণাঙ্গ সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের ১৫তম সাক্ষী মো. রমিজ উদ্দিন ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল আদালতে সাক্ষ্য দেন।
এছাড়া ২০১৫ সালের ৭ মে আদালতে মামলায় বাদী অবশিষ্ট সাক্ষ্য দেন। আর বাদীর পূর্ণাঙ্গ সাক্ষ্যের পর থেকে দীর্ঘ ৩ বছর কোনো সাক্ষ্য হয়নি। দীর্ঘদিন পর ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানার তৎকালীন এসআই ডিস্ট্রিক ইন্টেলিজেন্স অফিসার তোফাজ্জল হোসেন এবং একই দিন পুলিশের এডিসি নুরুল ইসলাম আদালতে সাক্ষ্য দেন।
এরপর চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি পুলিশের এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান আদালতে সাক্ষ্য দেন। সর্বশেষ ১ জুলাই সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য ছিল। কিন্তু এদিন সাক্ষী উপস্থিত হননি। এজন্য রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদন মঞ্জুর করে পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১৯ আগস্ট দিন ধার্য করেন আদালত।
৪৪ বছর আগে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৯৯৬ সালে মামলা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের সময় সেনা সদস্যরা কামানের গোলা ছুড়লে তা গিয়ে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডর ৮ ও ৯ এবং ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির (টিনশেড বস্তি) ওপর পড়ে।
লে. কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) ছোড়া কামানের গোলার শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বস্তি। ওই ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ১৩ জন নিহত হন। প্রায় ৪০ জন আহত হন।
আহতদের মধ্যে কয়েকজন পুরুষ সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেন। নিহতরা হলেন- রিজিয়া বেগম ও তার ৬ মাসের মেয়ে নাসিমা, কাশেদা বেগম, ছাবেরা বেগম, সাফিয়া খাতুন, আনোয়ার বেগম (১), ময়ফুল বিবি, আনোয়ার বেগম (২), হাবিবুর রহমান, আবদুল্লাহ, রফিজল, সাহাব উদ্দিন আহম্মেদ ও আমিন উদ্দিন আহম্মেদ। ওই ঘটনায় ৮ নম্বর বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় মামলাটি করেন। ২০০১ সালের এপ্রিলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেয়। এরপর ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত।
১৭ আসামির মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড অন্য মামলায় কার্যকর করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তারা হল- লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ। এ মামলায় তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে (প্রয়াত) গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল। এছাড়া মামলার বাকি ১১ আসামি পলাতক রয়েছেন। তারা হল- লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) শরিফুল হক ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ইবি, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আহমদ শরিফুল হোসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মো. কিসমত হাসেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার, রিসালদার (অবসরপ্রাপ্ত) মোসলেম উদ্দিন ওরফে মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী ও এলভি মো. আলী হোসেন মৃধা।